রাসুলুল্লাহ (সাঃ) - এর নবুঅত লাভ ও সালাতের নির্দেশনা - Islamic story Bangla

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) - এর নবুঅত লাভ ও সালাতের নির্দেশনা

mohanobir jiboni bangla

নবুঅতের দ্বারপ্রান্তে নিঃসঙ্গপ্রিয়তা:

নবুঅত লাভের সময়কাল যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল, তাঁর মধ্যে নিঃসঙ্গপ্রিয়তার প্রবণতা ততই বাড়তে লাগল। এক সময় তিনি কা‘বা গৃহ থেকে প্রায় ৬ কিঃ মিঃ উত্তর-পূর্বে হেরা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ৪১১/৩ গজ আকারের ছোট গুহার নিরিবিলি স্থানকে বেছে নিলেন। বাড়ী থেকে পানি ও ছাতু নিয়ে যেতেন। ফুরিয়ে গেলে আবার আসতেন। কিন্তু বাড়ীতে তার মন বসতো না। কখনো কখনো সেখানে রাত কাটাতেন। পরপর ২টি রামাযান তিনি সেখানে ই‘তেকাফে কাটান।

mohanobir jiboni bangla

বয়স চল্লিশে পদার্পণ করল। রবীউল আউয়ালের জন্ম মাস থেকে শুরু হ’ল ‘সত্য স্বপ্ন’ (الرؤيا الصادقة) দেখা। তিনি স্বপ্নে যাই দেখতেন তাই-ই দিবালোকের মত সত্য হয়ে দেখা দিত। এভাবে চলল প্রায় ছয় মাস।

যা ছিল ২৩ বছরের নবুঅতকালের ৪৬ ভাগের এক ভাগ। রাসূলের নির্জনতা ও একাগ্রতা এমনভাবে বেড়ে গেল যে, এখন আর তিনি বাড়ী ফিরতে চান না। খাদীজা তাকে খাদ্য সরবরাহ ও অন্যান্য সহযোগিতা করতে থাকলেন। স্বগোত্রীয় লোকদের পৌত্তলিক ও বস্ত্তবাদী ধ্যানধারণা তাকে পাগল করে তুলত।

নুযূলে কুরআন:

এভাবে এসে গেল সেই শুভক্ষণ। ২১শে রামাযান সোমবারের ক্বদরের রাত্রি। ফেরেশতা জিবরীলের আগমন হল। ধ্যানমগ্ন মুহাম্মাদকে বললেন, اِقْرَأْ ‘পড়’। বললেন, مَاأَنَا بِقَاِرئ ‘আমি তো পড়তে জানিনা’। অতঃপর তাকে বুকে চেপে ধরলেন ও বললেন, পড়। কিন্তু একই জবাব, ‘পড়তে জানিনা’। এভাবে তৃতীয়বার আলিঙ্গন শেষে তিনি পড়তে শুরু করলেন,

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ- خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ- اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ- الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ- عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ-

(১) ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’

(২) ‘সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে’

(৩) ‘পড় এবং তোমার প্রভু বড়ই দয়ালু’

(৪) ‘যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দান করেছেন’

(৫) ‘তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না’। মাত্র পাঁচটি আয়াত নাযিল হল। তারপর ফেরেশতা অদৃশ্য হয়ে গেল।

নতুনের শিহরণ ও খাদীজার বিচক্ষণতা

নতুন অভিজ্ঞতা লাভে শিহরিত মুহাম্মাদ দ্রুত বাড়ী ফিরলেন। স্ত্রী খাদীজাকে বললেন, زَمِّلُوْنِى زَمِّلُوْنِى ‘শিগগীর আমাকে চাদর মুড়ি দাও। চাদর মুড়ি দাও’। কিছুক্ষণ পর ভয়ার্তভাব কেটে গেলে সব কথা খাদীজাকে খুলে বললেন। রাসূলের নিকটে খাদীজা কেবল স্ত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন তাঁর নির্ভরতার প্রতীক ও সান্ত্বনার স্থান। ছিলেন বিপদের বন্ধু।

তিনি অভয় দিয়ে বলে উঠলেন, এটা খারাপ কিছু হতেই পারে না। ‘কখনোই না। আল্লাহর কসম! তিনি কখনোই আপনাকে অপদস্থ করতে পারেন না। ‘আপনি আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করেন, দুস্থদের বোঝা বহন করেন, নিঃস্বদের কর্মসংস্থান করেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করেন এবং বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করেন’।

অতঃপর তিনি তাঁকে সাথে নিয়ে চাচাতো ভাই অরাক্বা বিন নওফেলের কাছে গেলেন। যিনি ইনজীল কিতাবের আলেম ছিলেন এবং ঐ সময় চরম বার্ধক্যে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সবকথা শুনে বললেন, ‘এ তো সেই ফেরেশতা যাকে আল্লাহ মূসার প্রতি নাযিল করেছিলেন। হায়! যদি আমি সেদিন তরুণ থাকতাম! হায়! যদি আমি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কওম তোমাকে বহিষ্কার করবে’।

একথা শুনে চমকে উঠে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘ওরা কি আমাকে বের করে দিবে’? অরাক্বা বললেন, ‘হ্যাঁ! তুমি যা নিয়ে আগমন করেছ, তা নিয়ে ইতিপূর্বে এমন কেউ আগমন করেননি, যার সাথে শত্রুতা করা হয়নি’। অতঃপর অরাক্বা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, إِ ‘যদি তোমার সেই দিন আমি পাই, তবে আমি তোমাকে যথাযোগ্য সাহায্য করব’।

অহি-র বিরতিকাল

অরাক্বা বিন নওফেলের কাছে সবকিছু শুনে নবী করীম (সাঃ) আশা ও আশংকার দোলায় দোলায়িত হয়ে পুনরায় হেরা গুহায় ই’তেকাফে ফিরে এলেন এবং পুনরায় অহি নাযিলের অপেক্ষা করতে লাগলেন। এভাবে দশদিন অতিবাহিত করে রামাযান শেষে পূর্বের নিয়মানুযায়ী ১লা শাওয়াল সকালে ই’তেকাফ শেষ করে বাড়ী অভিমুখে রওয়ানা হলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, এমন সময় আমি আসমান থেকে একটা আওয়ায পাই।

তাকিয়ে দেখি যে, সেদিনের সেই ফেরেশতা আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী স্থানে কুরসীর উপরে বসে আছেন। আমি ভীত বিহবল হয়ে মাটিতে পড়ে যাবার উপক্রম হই। অতঃপর দ্রুত বাড়ী ফিরে স্ত্রীকে বলি, আমাকে চাদর মুড়ি দাও, চাদর মুড়ি দাও, চাদর মুড়ি দাও’।

কিন্তু না অল্পক্ষণের মধ্যেই গুরুগম্ভীর স্বরে ‘অহি’ নাযিল হ’ল-

يَآ أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ- قُمْ فَأَنذِرْ- وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ- وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ- وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ-

(১) ‘হে চাদরাবৃত!

(২) উঠো, মানুষকে (আল্লাহর) ভয় দেখাও,

(৩) তোমার প্রভুর মাহাত্ম্য ঘোষণা কর,

(৪) তোমার পোশাক পবিত্র রাখো,

(৫) অপবিত্রতা পরিহার কর’(মুদ্দাছছির ৭৪/১-৫)।

এরপর থেকে ‘অহি’ চালু হয়ে গেল’। ২১শে রামাযানের কদর রাতে প্রথম অহি নাযিলের পর থেকে এই দশদিনের বিরতিকালকে فترة الوحى বা অহি-র বিরতিকাল বলা হয়। এটি আড়াই বা তিন বছরের জন্য ছিল না, যা প্রসিদ্ধ আছে। = (আর-রাহীক্ব পৃঃ ৬৯)।

অহি-র প্রকারভেদ:
‘অহি’ (الوحى) অর্থ প্রত্যাদেশ, যা আল্লাহর পক্ষ হ’তে তাঁর নির্বাচিত বান্দার নিকটে হয়ে থাকে। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম নবীদের নিকটে অহি-র সাতটি প্রকারভেদ বর্ণনা করেছেন:-

(১) সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে।

(২) অদৃশ্য থেকে হৃদয়ে অহি-র প্রক্ষেপন, যা জিব্রীল মাঝে-মধ্যে রাসূলের উপরে করতেন

(৩) মানুষের রূপ ধারণ করে জিব্রীল এসে অহী বর্ণনা করে শুনাতেন।

(৪) ঘণ্টাধ্বনির আওয়ায করে ‘অহি’ নাযিল হ’ত। এ সময় রাসূল (সাঃ) খুব কষ্ট অনুভব করতেন।

(৫) জিব্রীল (আঃ) স্বরূপে এসে অহি প্রদান করতেন। এটি দু’বার ঘটেছে

(৬) মে‘রাজ রজনীতে আসমানে অবস্থানকালে আল্লাহর সরাসরি অহি-র মাধ্যমে ছালাত ফরয করণ

(৭) আল্লাহ স্বীয় নবীর সঙ্গে সরাসরি ফেরেশতার মাধ্যম ছাড়াই পর্দার অন্তরাল থেকে কথা বলেন। যেমন মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে তূর পাহাড়ে কথা বলার প্রমাণ কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এবং শেষনবীর সঙ্গে মে‘রাজ রজনীতে আরশের নিকটে কথোপকথনের প্রমাণ হাদীছে বিধৃত হয়েছে। (আর-রাহীক্ব পৃঃ ৭০)।

ছালাতের নির্দেশনা

মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে নবুঅতের শুরু থেকেই সকাল ও সন্ধ্যায় দু’বার ছালাত আদায়ের নির্দেশনা দান করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِبْكَارِ

‘তুমি তোমার প্রভুর প্রশংসা জ্ঞাপন কর সন্ধ্যায় ও সকালে’ (মুমিন/গাফের ৪০/৫৫)।

প্রথম কুরআন নাযিলের পর জিব্রীলের মাধ্যমে তিনি ওযূ ও ছালাত আদায় শিখেন।হিজরতের স্বল্পকাল পূর্বে মে‘রাজ সংঘটিত হবার আগ পর্যন্ত ফজরের দুরাক‘আত ও মাগরিবের দুরাক‘আত করে ছালাত আদায়ের নিয়ম জারি থাকে। অতঃপর নিয়মিতভাবে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয হয় মে‘রাজের রাত্রিতে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর সাথীগণ প্রথম তিন বছর গোপনে এই ছালাত আদায় করতেন এবং লোকদেরকে গাছ, পাথর, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদির উপাসনা পরিত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদত শিক্ষা দিতেন।

পরে يَااَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ (হে বস্ত্রাবৃত!) বলে সূরা মুযযাম্মিল নাযিল করে আল্লাহ রাতে প্রায় সিকি অংশ তাহাজ্জুদের ছালাতে কাটিয়ে দেবার জন্য তাঁর নবী ও সাথীদের উপরে ফরয করে দেন। পরবর্তীতে মে‘রাজে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয হলে তাহাজ্জুদ নফল হয়ে যায়

More:  ঈমানের সাথে আমল প্রয়োজন

Post a Comment

1 Comments

Please Don't Send Any Spam Link