বনু নাযীর যুদ্ধ
(৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২৫ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট মাস)
ইসলাম ও মুসলমানের প্রতি চরম বিদ্বেষী মদীনার ইহুদী গোত্রগুলির অন্যতম হল বনু নাযীর গোত্র । তারা তওরাতে বর্ণিত বিবরণ অনুযায়ী শেষনবীকে ঠিকই চিনেছিল। কিন্তু তিনি বনু ইস্রাঈল বংশের না হয়ে বনু ইসমাঈল বংশের হওয়ায় তারা তাঁকে মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং সর্বপ্রকার শত্রুতায় লিপ্ত হয়। জঙ্গে জামাল উষ্ট্রের যুদ্ধ
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় এসে
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় এসে অন্যদের ন্যায় তাদের সাথেও শান্তি চুক্তি করেন। তাতে বলা ছিল যে, কেউ কারু বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না। শত্রুকে সাহায্য করবে না। রক্তমূল্য আদায়ের সময় পরস্পরকে সাহায্য করবে।
সকলে রাসূলকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে মদীনাকে রক্ষা করবে। হুওয়াই বিন আখত্বাব, সালাম বিন আবুল হুক্বাইক্ব, সালাম ইবনু মুশকিম প্রমুখ ছিল এদের নেতা। ২য় হিজরীতে বদর যুদ্ধের এক মাস পরে অন্যতম ইহুদী গোত্র বনু ক্বায়নুক্বার বিতাড়ন ও ৩য় হিজরীর মধ্য রবীউল আউয়ালে ইহুদী নেতা কা‘ব বিন আশরাফের হত্যাকান্ডের ফলে তাদের মধ্যে সাময়িকভাবে যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল, ৩য় হিজরীর শাওয়ালে ওহোদ যুদ্ধে বিপর্যয়ের ফলে তা দূরীভূত হয়।
অঙ্গীকার
তারা পুনরায় অঙ্গীকার ভঙ্গ করা এবং মদীনার মুনাফিক ও মক্কার মুশরিক নেতাদের সাহায্য করার মাধ্যমে চক্রান্তমূলক তৎপরতা শুরু করে দেয়।
সবকিছু জানা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পূর্বের সন্ধিচুক্তির কারণে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে সবকিছু হযম করতেন। কিন্তু রাজী‘-তে ১০ জন ও মাঊনাতে ৬৯ জন নিরীহ মুবাল্লিগকে প্রতারণা ও চরম বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে মর্মান্তিকভাবে হত্যা করার ঘটনার মধ্য দিয়ে তাদের ঔদ্ধত্য চরমে উঠে যায়। এরপরেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ধৈর্য ধারণ করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে তারা খোদ রাসূলকেই হত্যা করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে।
ঘটনা ছিল এই যে, মাঊনার মর্মন্তুদ ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একমাত্র ব্যক্তি আমর বিন উমাইয়া যামরী (রাঃ) মদীনায় ফেরার পথে ‘কারকারা’ নামক স্থানে দু’জন কাফিরকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেন। এর মাধ্যমে তিনি সঙ্গীদের নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন।
রাসূলের সন্ধিচুক্তি ছিল
কিন্তু ঐ দু’জন ব্যক্তি ছিল বনু কেলাব গোত্রের, যাদের সাথে রাসূলের সন্ধিচুক্তি ছিল, যা আমরের জানা ছিল না। মদীনায় এসে ঘটনা বিবৃত করলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, তুমি এমন কাজ করেছ যে, এখন আমাদেরকে রক্তমূল্য দিতে হবে।
অতঃপর রক্তমূল্য সংগ্রহের জন্য তিনি আবুবকর, ওমর, আলী ও আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে মদীনা হতে দুমাইল দূরে বনু নাযীর গোত্রে গমন করেন। কারণ তাদের সঙ্গে পূর্বে কৃত সন্ধি চুক্তি এভাবেই ছিল যে, রক্তমূল্য আদায়ে তারা পরস্পরকে সাহায্য করতে বাধ্য থাকবে।
তাদের সঙ্গে আলাপের পর তারা রাযী হয়ে যায় এবং তারা তাদের একটি বাড়ীতে রাসূলকে বসিয়ে রক্তমূল্য আনতে যায়। রাসূল ও তাঁর সাথীগণ সেখানে অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু ইহুদী নেতারা গোপনে একত্রিত হলেই শয়তান তাদের পেয়ে বসে এবং রাসূলকে সেখানেই হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
তাদের অন্যতম নেতা ও গোত্রের কোষাধ্যক্ষ সালাম বিন মুশকিম একাজে বাধা দিয়ে বলেন, তোমরা একাজ করো না। আল্লাহর কসম! এটা তাকে অবগত করানো হবে। অধিকন্তু আমাদের ও তাদের মধ্যে যে সন্ধিচুক্তি রয়েছে একাজটি তার বিপরীত হবে’।
নিয়োগ করা হল
কিন্তু তারা কোন কথা শুনলো না। আমর বিন জাহহাশকে নিয়োগ করা হল এজন্য যে, দেয়ালের উপর থেকে পাথরের ভারি চাকি নিক্ষেপ করে সেখানে নীচে উপবিষ্ট রাসূলকে সে অতর্কিতে হত্যা করবে।
তাদের এই চক্রান্তের কথা জিব্রীল আল্লাহর হুকুমে রাসূলকে সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেন এবং তিনি দ্রুত সেখান থেকে উঠে চলে আসেন। তিনি ছাহাবায়ে কেরামকে ইহুদীদেরকে এই ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের কথা অবহিত করেন।
অতঃপর মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহকে তখনই বনু নাযীরের কাছে এই নির্দেশসহ প্রেরণ করেন যে, তারা যেন অনতিবিলম্বে মদীনা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। এজন্য তাদেরকে দশদিনের সময় দেওয়া হল। এরপর সেখানে কাউকে পাওয়া গেলে তাদের সবাইকে হত্যা করা হবে।
এই দশদিন সময়ের মধ্যেই শয়তান তাদেরকে আবার ধোঁকায় ফেলল। মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তাদের যেতে নিষেধ করল। সে তার দু’হাযার সেনা দিয়ে তাদের সাহায্য করার অঙ্গীকার করল।
এতদ্ব্যতীত আরেকটি ইহুদী গোত্র বনু কুরায়যা ও বেদুঈন গোত্র বনু গাৎফান তাদের সাহায্য করবে বলে আশ্বস্ত করল। বনু নাযীর নেতা হুয়াই বিন আখত্বাব মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কথার উপরে বিশ্বাস রেখে মদীনা পরিত্যাগ না করে মুসলমানদের সাথে মুকাবিলার সিদ্ধান্ত নিল।
এ সিদ্ধান্ত তারা যথারীতি রাসূলকে জানিয়ে দিল। তখন রাসূল (সাঃ) যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। অতঃপর আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূমের উপরে মদীনার দায়িত্বভার অর্পণ করে তিনি বনু নাযীর দুর্গ অবরোধ করেন।
ইহুদীরা দুর্গ প্রাচীর থেকে মুসলিম বাহিনীকে লক্ষ্য করে তীর ও প্রস্তর সমূহ ছুঁড়তে থাকে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। অবরোধ ৬দিন মতান্তরে ১৫দিন অব্যাহত থাকে। তারা যখন দেখল যে, কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না, তখন তারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হল।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে অস্ত্র-শস্ত্র ছাড়া বাকী সব মালামাল নিয়ে পরিবার-পরিজনসহ চলে যাবার অনুমতি দিলেন। তারা নিজেদের হাতে গড়া ঘরবাড়ি নিজেরা ভেঙ্গে দরজা-জানালা সহ ৬০০ উট বোঝাই করে নিয়ে চলে যায়।
গোত্রনেতা হুয়াই বিন আখত্বাব, সালাম বিন আবুল হুক্বাইক্ব সহ অধিকাংশ ইহুদী ৬০ মাইল দূরে খায়বরে চলে যায়। বাকী কিছু অংশ সিরিয়া চলে যায়। তবে তাদের মধ্যে ইয়ামীন বিন আমর ও আবু সা‘দ বিন ওয়াহাব নামক দু’জন ব্যক্তি ইসলাম কবুল করেন। ফলে তাদের মালামাল সবই অক্ষত থাকে।
রাষ্ট্রীয় সম্পদ
বনু নাযীরের পরিত্যক্ত সম্পত্তি গনীমত নয় বরং ‘ফাই’ হিসাবে গণ্য হয়। কেননা এখানে কোন যুদ্ধের প্রয়োজন হয়নি। ফলে তা বণ্টিত হয়নি। সবটাই রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসাবে সংরক্ষিত হয়। যা তিনি পরবর্তী যুদ্ধ প্রস্তুতি ও অন্যান্য দান-ছাদাক্বাহর কাজে ব্যয় করেন। অবশ্য সেখান থেকে কিছু অংশ তিনি ব্যয় করেন নিজস্ব অধিকার বলে প্রথম দিকে হিজরতকারী ছাহাবীগণের মধ্যে।
কিছু দেন অভাবগ্রস্ত আনছার ছাহাবী আবু দুজানা ও সাহল বিন হুনায়েফকে এবং কিছু রাখেন নিজ স্ত্রীগণের বৎসরের খোরাকির জন্য। এ বিষয়ে সূরা হাশর ৬-৭ আয়াত দ্বয় নাযিল হয়।
তাদের এই নির্বাসনকে কুরআনে أول الحشر বা ‘প্রথম একত্রিত বহিষ্কার’ (হাশর ৫৯/২) বলে অভিহিত করা হয়। বনু নাযীরকে রাসূলের বিরুদ্ধে উসকে দেবার কাজে মুনাফিকদের প্ররোচনা দান অতঃপর পিছিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে আল্লাহ পাক সরাসরি শয়তানের কাজের সঙ্গে তুলনা করে বলেন,
كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنْسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّيْ بَرِيْءٌ مِّنْكَ إِنِّيْ أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِيْنَ- فَكَانَ عَاقِبَتَهُمَا أَنَّهُمَا فِي النَّارِ خَالِدَيْنِ فِيْهَا وَذَلِكَ جَزَاءُ الظَّالِمِيْنَ-
‘তারা শয়তানের মত, যে মানুষকে কাফের হ’তে বলে। অতঃপর যখন সে কাফের হয়, তখন শয়তান বলে, তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি বিশ্ব পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করি’। ‘অতঃপর উভয়ের পরিণতি হবে এই যে, তারা উভয়ে জাহান্নামে যাবে এবং সেখানে চিরকাল বাস করবে। এটাই হল যালেমদের প্রতিফল’ (হাশর ৫৯/১৬-১৭)।
কাফিরমুক্ত করতে চেয়েছেন
মূলতঃ এর দ্বারা আল্লাহ পাক আরব উপদ্বীপকে কাফিরমুক্ত করতে চেয়েছেন এবং সেটাই পরে বাস্তবায়িত হয়েছে বনু কুরায়যার বিশ্বাসঘাতকতার চূড়ান্ত শাস্তি ও বিতাড়নের মাধ্যমে এবং সবশেষে হযরত ওমর (রাঃ) কর্তৃক খায়বর থেকে দ্বিতীয়বার ইহুদীদের বিতাড়নের মাধ্যমে।
0 Comments
Please Don't Send Any Spam Link