হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) জীবন কাহিনী Part 26 - হুযুরে পাক (সাঃ)-এর সাথে খাদীজা (রাঃ)-এর শুভ পরিণয়

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) জীবন কাহিনী, islamic history bangla

হুযুরে পাক (সাঃ)-এর সাথে খাদীজা (রাঃ)-এর শুভ পরিণয়

হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) পরম নিষ্ঠা ও সততার সাথে বিবি খাদীজা (রাঃ)-এর ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে সহযােগিতা দিয়ে যেতে লাগলেন। তার প্রত্যেকটি কাজের ভিতর দিয়ে সকল প্রকার গুণ, উন্নত চরিত্র, সততা, নিষ্ঠা এবং শ্রেষ্ঠ যােগ্যতার পরিচয় পাওয়া যেতে লাগল। হযরত খাদীজা (রাঃ) তার এসব।


More Info: সাহাবীগণের উপর অত্যাচার

গুণাবলী দেখতে পেয়ে

ক্রমেই তাঁর প্রতি অধিক আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। এমনকি তিনি আর বিবাহ করবেন না বলে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তা ভুলে গেলেন এর বিবাহের মাধ্যমে নূতন করে সংসার করবেন বলে দৃঢ়সংকল্প করলেন।

বিবি নাফিসা নামের হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর জনৈকা বুদ্ধিমতি। পরিচারিকা ছিল। হযরত খাদীজা (রাঃ) একদিন তার নিকট নিজের মনের ইচ ব্যক্ত করলেন। নাফিসা তাঁকে বলল, আপনার আর কিছুই বলতে হবে না, আমি সবকিছু ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
 

 একদিন নাফিসা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে প্রথমত, ব্যবসা সম্পর্কিত আলােপালােচনা করে কথায় কথায় হুযুরে পাক (সাঃ)-কে এখনও তার বিবাহ না করার কারণ জিজ্ঞেস করল। হুযুরে পাক (সাঃ) তাঁর। আর্থিক অনটনজনিত কারণের কথা জানালেন।

প্রতুত্তরে নাফিসা বলল, মনে করুন, যদি কোন সুন্দরী, বুদ্ধিমতি, বিদূষী এবং বিরাট ধনশালিনী মহিলা আপনাকে বিবাহ করতে রাজী হয় এবং বিবাহ বাবত আপনার সকল খরচ বহন করতে থাকে, তবে আপনি এ প্রকার বিবাহ করতে রাজী আছেন কি ?

হুযুরে পাক (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন

কে এমন মহিলা, যে আমার জন্য এতকিছু করতে প্রস্তুত হবে ? নাফিসা বললেন, সেটা তারই ভাববার কথা, আপনার নয়। আপনি শুধু আপনার মতামতটির কথা বলুন।

হুযুরে পাক (সাঃ) বললেন, এমন মহিলার পরিচয়টা শুনতে পারি কি ? নাফিসা বলল, মনে করুন যদি সে মহিলা খুওয়াইলিদ কন্যা হযরত খাদীজা (রাঃ) নিজে হন, তবে আপনি কি রাজী আছেন ?

হুযুরে পাক (সাঃ) বললেন

এতাে আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের কথা। তবে এ ব্যাপারে আমার চূড়ান্ত মতামত নির্ভর করে আমার চাচা আবু তালিবের উপর। যেহেতু তিনি আমার মুরব্বি । অতএব, এবিষয় তাঁর সঙ্গে একটু পরামর্শ। এবং আলাপালােচনা করে নিতে হয়।
নাফিসা বলল, হাঁ তাতাে অবশ্যই করতে হয়। তবে তা আপনার নিজের ব্যাপার বলে চাচার সাথে এবিষয়ে আলােচনা করতে আপনার কিছুটা সঙ্কোচ। হতে পারে।

আমি আপনাকে সে ব্যাপারে অসুবিধায় না ফেলে সে ভারও আমি গ্রহণ। তরলাম। আমিই আপনার চাচার সাথে এ ব্যাপারে কথা পাকাপাকি করব।।
হুযুরে পাক (সাঃ) বললেন, তা হলে তাে ভালই হয়।

এরপর নাফিসা হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে নিজের সাফল্যের খবর জানিয়ে সমস্ত কথা আনুপূর্বিক তাঁর নিকট বর্ণনা করল। তিনি শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন। এরপর নাফিসা হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর অনুমতিক্রমে আবু তালিবের নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে বলল, আপনার ভাতিজা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে বিবি খাদীজা (রাঃ)-এর বিবাহ হতে পারে কি না? এ ব্যাপারে। আপনার মতামত প্রকাশ করুন। আবু তালিব তার দরিদ্র ভাতিজার বিবাহের।

ব্যাপারে নিজেই উগ্রীব এবং চেষ্টায় ছিলেন; কিন্তু খাদীজার মত অত বড় ধনবতী এবং বিদুষী মহিলা যে তার অভাবগ্রস্ত ভাতিজার সাথে বিবাহে রাজী। হবেন এ তিনি ভাবতেও পারেন নি। এরূপ ঘটনা সাধিত হলে তা যে ভাতিজা।

মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্য খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার হবে তিনি এ ভাল করেই জানতেন। তবু নাফিসার কাছে নিজের মনের কথা মােটামুটিভাবে প্রকাশ করে এরূপ জবাব দিলেন যে, ভাতিজা মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সঙ্গে আলােচনা করে তার মতামত না জেনে তাে আমি চূড়ান্ত কথা বলতে পারি না। তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত হল, এটা অত্যন্ত ভাল প্রস্তাব।

নাফিসা বলল, আশা করি তিনি এ ব্যাপারে রাজী হবেন। তবে আপনি তাঁর সাথে পরামর্শ ও আলাপালােচনা করে এ প্রস্তাব উত্তম মনে করলে আশা করি আপনিই পাত্রের পক্ষ হতে প্রস্তাবটি পাত্রী পক্ষের মুরব্বীর কাছে উত্থাপন। করবেন। যেহেতু পাত্র পক্ষের তরফ হতেই প্রস্তাব উত্থাপন করার নিয়ম।

নাফিসা বিদায় হল। এরপর আবু তালিব অত্যন্ত খুশী মনে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে এ বিষয়ে কথাবার্তা বলে স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তারপর আবু তালিব হযরত খাদীজার পক্ষীয় আমর ইবনে আসাদ এবং ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে উপস্থিত হয়ে প্রস্তাবটি পেশ করলেন। তারা সানন্দে সম্মতি জানালেন। আবু তালিব নিজেই খাদীজার পক্ষীয় ঐ দু’ব্যক্তির সাথে বিবাহের সকল শর্তাদি এবং দিন তারিখ নির্দিষ্ট করে ফেললেন।

এ সময় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বয়স পঁচিশ বছর এবং খাদীজা (রাঃ)-এর বয়স ছিল চল্লিশ বছর। পাত্র ও পাত্রীর এ বয়সের পার্থক্যের বিষয়।

আবু তালিব চিন্তা করেননি তা নয়। তবে খাদীজার মত সর্বগুণ সম্পন্ন সুন্দরী ধনবতী রমণীর বিবাহের বেলায় ঐ সামান্য একটা ওজর মােটেই ধরার মত নয়। মহাবিজ্ঞ আবু তালিব তা জানতেন। ( বিবাহের তারিখ ঠিক হয়েছিল দশই রবিউল আউয়াল।

নির্ধারিত তারি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পক্ষ হতে আবু তালিব, হযরত আমীর হামত আব্বাস এবং আরও কতিপয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আত্মীয়-স্বজন এবং হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর পক্ষে তাঁর চাচা আমর ইবনে আসাদ, ওয়ারাকা ইবয়ে নওফেল এবং আরও কতিপয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আত্মীয়-স্বজন হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর বাড়ীতে উপস্থিত হয়ে শুভ বিবাহ সম্পন্ন করে দিলেন।

বিবাহ অনুষ্ঠানে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চাচা ও অভিভাবক আবু তালিব। উঠে দাঁড়িয়ে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দান করলেন। তিনি উপস্থিত ব্যক্তিগণকে লক্ষ্য করে বললেন ঃ সকল প্রশংসা সে মহাপ্রভু আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে মহামান্য নবী হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর বংশে জন্মগ্রহণ করার সৌভাগ্য দান করেছেন। আর কাবা ঘর রক্ষণাবেক্ষণ করার সৌভাগ্য দান ও সম্মান প্রদানে সম্মানিত করেছেন।

তারপর আমি আপনাদেরকে বলতে চাই যে, আমার ভাতিজা। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) অর্থের দিক দিয়ে নিঃস্ব হলেও সে সর্বগুণে গুণান্বিত যুবক। একথা আমি অত্যন্ত গর্বের সাথে উচ্চারণ করছি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস যে, আরবের প্রত্যেকটি লােকই আমার একথা সমর্থন করবে। আর আমার বধূমাতা খাদীজা।

পরমা সুন্দরী, যথেষ্ট বিদূষী এবং অতুলনীয় ধন-সম্পদের অধিকারিণী হয়েও যে আমার নিরক্ষর ও নিঃস্ব ভাতিজা মুহাম্মদ (সাঃ)-কে পতিত্বে বরণ করতে সম্মত হয়েছে তাতে তার সূক্ষ্ম জ্ঞান ও বিচণক্ষতারই পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। সে এ দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে আমাদের প্রশংসাই করেছে।

সবশেষে আমি সর্বান্তঃকরণে এ সদ্য শুভ পরিণীতা নব-দম্পতির দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনের স্থায়ী সুখ-শান্তি কামনা করেই আমার বক্তব্য সমাপ্ত করছি।
এরপর হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর পক্ষ হতে পিতব্য-পুত্র ওয়ারাকা ইবনে। নওফেল দাড়িয়ে উপস্থিত জনতাকে লক্ষ্য করে একটি ভাষণ দান করলেন।

তিনি বললেন ঃ ‘অসংখ্য প্রশংসা সে আল্লাহর যিনি আমাদেরকে সমগ্র আরবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সন্তানের অধিকারী করেছেন। বংশ গৌরবে হযরত মুহাম্মদ। (সাঃ) এবং খাদীজা (রাঃ) কেউ কারও চেয়ে হেয় নয়। এদের উভয়েরই।

পর্ব-পুরুষ কয়েক ধাপ উপরে গিয়ে একই ব্যক্তি ছিলেন। আজ আবার দুটি বংশের মধ্যে নূতন সম্পর্ক গড়ে উঠল। আমারও স্থির বিশ্বাস যে, এ বিবাহে সম্মতি দান করে আমরা কেউই ভুল করিনি; বরং উভয় পক্ষই সাফল্য অর্জন। করেছি ও লাভবান হয়েছি। আমাদের বংশ গৌরব অপেক্ষা হাশেমীদের বংশ মর্যাদা অনেক উর্ধ্বে তা স্বীকার করতে আমার কোন দ্বিধা নেই।

সে হিসেবে খাদীজা (রাঃ) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে স্বামীতে বরণ করে যে আমাদের। সম্মানই বদ্ধি করেছে তা নয় বরং সে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার ও দূরদর্শিতার পরিচয়। দিয়েছে। কেননা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মত জ্ঞানী, সচ্চরিত্র ও সত্যবাদী।

যুবক সমগ্র আরবে যে আর দ্বিতীয় কেউ নেই, তা আরবের প্রত্যেকটি লােকই এক বাক্যে স্বীকার করবে। হে উপস্থিত কোরাইশ ভদ্র মহােদয়গণ! আমি আপনাদের সকলের সামনে মুহাম্মদ (সাঃ) ইবনে আবদুল্লাহর হাতে খাদীজা।

বিনতে খুওয়াইলিদকে শুভ পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করে দিলাম। আমি আল্লাহর দরবারে দোয়া জানাচ্ছি, আমাদের এ পাত্র-পাত্রী নির্বাচন সার্থক হােক এবং এ। নবদম্পতির জীবন সার্থক এবং শান্তি ও সুখে ধন্য হয়ে উঠুক।

পারিবারিক জীবন

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর এ বিবাহের। ফলাফল সত্য সত্যই মধুর এবং শান্তিময় হয়েছিল। দাম্পত্য জীবনে তাদের মত সুখী দম্পতি পৃথিবীতে অন্য কেউ হয়নি। বিবাহের পর হযরত খাদীজা (রাঃ)। আবু তালিবকে এত অধিক পরিমাণে আর্থিক সাহায্য দান করেছিলেন যে, তদ্বারা। ব্যবসা-বাণিজ্য করে তিনি পরবর্তী জীবন যথেষ্ট সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে অতিবাহিত করেছিলেন।

বিবাহের পর হযরত খাদীজা (রাঃ) তাঁর অগাধ ধন-সম্পত্তি সমস্তই স্বামী, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর হাতে তুলে দিলেন এবং বললেন, আমার এ অর্থ-সম্পদের একচ্ছত্র মালিক এখন আপনি। আপনি এ ধন-সম্পদ এখন। যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার ও খরচ করতে পারেন। * হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কোনদিনই ধন-সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না। তিনি যে উদ্দেশ্য সাধন করতে দুনিয়ায় এসেছিলেন ধন-সম্পদ তার অন্তরায়; সুতরাং তিনি স্ত্রী খাদীজা (রাঃ)-এর ধন-সম্পদ দু’হাতে গরীব-দুঃখীদের মাঝে

বিতরণ করে দিলেন। বিবি খাদীজা (রাঃ)-ও এতে কোন রকম অসন্তোষ প্রকাশ করে বরং খুশীই হলেন।।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবং তাঁর স্ত্রী হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর পারিবারিক জীবনে কোনদিন সামান্যমাত্র মনােমালিন্য বা কলহের সৃষ্টি হয়নি। চিরসখ অনাবিল শান্তির মধ্যে অতিবাহিত হয়েছিল তাঁদের পারিবারিক জীবন।।
 
অন্যান্য দম্পতির পারিবারিক জীবনের সাথে তাদের পার্থক্য ছিল এ যে মুহাম্মদ (সাঃ) দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনের দায়িত্ব যথাযথরূপে পালন করে তাঁর জীবনের যে মূল লক্ষ্য ছিল, সে পথে তিনি অপ্রতিহত গতিতে অগ্রসর হচ্ছিলেন। দিনরাত অদর্শিত স্রষ্টার ধ্যান-ধারণায় তিনি সময়ের বেশীর ভাগই কাটিয়ে দিতে লাগলেন।

সদা-সর্বদাই তিনি ধ্যান গম্ভীরভাবে অপার্থিব চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন। অবশ্য এর সাথে সাথে মানব কল্যাণমূলক কাজেও তিনি মনেপ্রাণে আত্মনিয়ােগ করতেন। সে সময়ের আরব সমাজের বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ ও কদর্যতাগুলাে তাকে খুবই ব্যথিত করত; সুতরাং তা সমাজ হতে উচ্ছেদ করতে তাঁর চেষ্টারও কমতি ছিল না।

চরিত্র ছিল তাঁর স্বচ্ছ আয়নার মত। তাঁর সে অনুপম চরিত্র এবং মধুর আচরণে আরবের লােকেরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল ও তাকে নিজেদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম লােক বলে স্বীকার করে নিতে তাদের কোন রকম দ্বিধা ছিল না।

কাবা ঘর মেরামত এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)

এর বিচক্ষণতার পরিচয় দান । হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিবি হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর সাথে বিবাহের বছর মক্কায় প্রবল বর্ষণের ফলে কাবা ঘরের দেয়ালে ফাটল ধরে তা ভূমিস্মাৎ হবার আশঙ্কা দেখা দিল। তখন কোরায়েশগণ সকলে সঙ্কল্প করল যে, তারা ঐ দেয়াল ভেঙ্গে ফেলে নূতন করে কা'বা ঘর গেথে উঠাবে; কিন্তু এরূপ সঙ্কল্প। করলেও তাদের কেউই আল্লাহর ঘর ভাংতে সাহস করল না।

তাদের মনে এ ভয়। ছিল যে, কেউ আল্লাহর ঘর ভাংতে গেলে হয়ত বা তার উপর আল্লাহ তায়ালার। গজব আসতে পারে। শেষ পর্যন্ত কেউই একাজে অগ্রসর না হওয়ায় অলীদ নামক। এক কোরায়েশ সর্দার বলল, তােমরা কেউ না পারলে আমিই কা’বার দেয়াল ভেঙ্গে দেব। আল্লাহ আমার কোন ক্ষতিই করবে না। কেননা, আমি কোন খারাপ।

উদ্দেশ্য নিয়ে কাবা ঘর ভাংব না

বরং নূতন করে তৈরি করার জন্যই ভাংব। একথা বলেই সে কাবা ঘরের দেয়ালের কিছু অংশ ভেঙ্গে ফেলল।
অন্যান্য লােকেরা কিন্তু তখনও অলীদের সঙ্গে কাজে শরীক হল না; বরং তারা পরস্পরে বলাবলি করতে লাগল, আজ রাত্রটা অপেক্ষা করে আগামীকল্য যা হয় করব।

অলীদের উপর কোন রকম বালা-মুসীবত অবতীর্ণ না হলে কাল সকলে মিলে আমরা কাবার দেয়াল ভেঙ্গে ফেলব। দেখা গেল, অলীদ সম্পূর্ণই নিরাপদ রইল, তাঁর কোনকিছুই হল না। ফলে পরদিন সকলেই গিয়ে কাবা ঘরের দেয়াল। ভেঙ্গে ফেলে তারা নূতনভাবে দেয়াল গেঁথে উঠাতে শুরু করল। | কাবা ঘরের দেয়াল ভাঙ্গার সময় নির্দিষ্ট জায়গা হতে হাজরে আসওয়াদ বা কালাে পাথর সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে রাখা হয়েছিল, কিন্তু এখন তা আবার যথাস্থানে স্থাপন করা নিয়ে বিভিন্ন দলপতির মধ্যে কলহ সৃষ্টির উপক্রম হল।

প্রত্যেক দলের নেতাই ভাবছিল যে, হাজরে আসওয়াদ স্থাপন একটি অত্যন্ত গৌরবের বিষয়; সুতরাং যে কবীলার নেতা তা স্থাপন করতে পারবে অন্যান্যরা তার নিকট হেয় হয়ে যাবে। | এরূপ ধারণা নিয়ে প্রত্যেকেই নিজের হাতে তা যথাস্থানে স্থাপন করার জন্য জেদ ধরে বসল।

এ বিবাদ ক্রমশঃ এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছল যে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা হয়ে পড়ল। শেষ পর্যন্ত পরস্পরের মধ্যে এরূপ একটা সমঝােতা হল যে, আগামীকাল ভােরে যে ব্যক্তি সকলের আগে বাবে ইব্রাহীম হয়ে কাবা ঘরের চত্বরে পৌছবে এবং সে এ ব্যাপারে যে ফায়ছালা করবে, আমরা নির্বিবাদে সকলে তার সে ফায়ছালাই মেনে নেব।

আল্লাহর মজী! পরদিন ভােরে কাবা ঘরের চত্বরে সকলের আগে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কেই দেখা গেল। তখন সকলে তাঁকেই এ বিষয়টির মীমাংসা করে দেয়ার জন্য ধরে বসল।

তিনি তখন একখানা বড় আকৃতির চাদর আনিয়ে হাজরে আসওয়াদের। নিকট গিয়ে বিবদমান প্রত্যেক গােত্রের নেতাকে বললেন, ‘চাদরখানা ধরে বিছাও। চাদর বিছানাের পরে তিনি নিজের হাতে পাথরখানা উঠিয়ে চাদরের উপর রেখে আবার তাদের প্রত্যেকের দ্বারা তা ধরিয়ে বললেন, 'এখন এ পাথরখানা যথাস্থানে নিয়ে যাও।' আদেশ মত সকল গােত্রনেতা চাদরের কোণায়।

কোণায় ধরে তা দেয়ালের যথাস্থানে উত্তোলন করল। এরপর তিনি নিজের হাতে চাদরের উপর হতে পাথরখানা উঠিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করলেন।।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার বিচক্ষণতার গুণে এভাবে একটি আসন্ন রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মুলােৎপাটন করে দিলেন। প্রত্যেক গােত্রের লােক এ ভেবে খুশী হল। যে, তারা উক্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজে সকলেই সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারল ।

হুযুরে পাক (সাঃ)-এর আধ্যাত্মিক সাধনা

হুযুরে পাক (সাঃ)-এর সাথে হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর বিয়ে হবার পর হযরত খাদীজা (রাঃ) তাঁর সকল ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে নিজে তাঁর সেবাদাসী হয়ে রইলেন। তখন ঐ ধন-সম্পদের তত্ত্বাবধান, হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর বিরাট ব্যবসায় পরিচালনা প্রভৃতি সবকিছুর দায়িত্ব ন্যস্ত হল হুযুরে পাক (সাঃ)-এর উপরে। অথচ হুযুরে পাক (সাঃ)-এর এসব কাজের প্রবৃত্তি ছিল।

এবং এর অবসরও ছিল না তাঁর। কেননা তিনি যে কেবল একটি চিন্তায়ই বিভাের। তাঁর মনে শুধু এ ভাবনা যে, লােকগণ কেন তাদের নিজেদের হাতে গড়া এ মূর্তি ও পুতুলগুলাে উপাসনা করে। এরা তাে মানুষের ভাল বা মন্দ কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না। তবে এই লােকেরা কেন বুঝতেছে না। তিনি একথাও চিন্তা করেন যে, তাঁর আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই যে পশুর মত জীবনযাপন করে। ইতর পশুর মতই তাদের আচার-ব্যবহার। কারও মনে কোনরূপ স্নেহ-ভালবাসা বা দয়া-মমতা নেই। একে অপরের দুঃখে দুঃখিত হয়।
 

সহানুভূতি প্রকাশ করে না। মানুষের ঐ অবাঞ্ছিত স্বভাব এবং আচরণ। কিভাবে দূর করে তাদের ভিতরে পরিবর্তন আনা যায়, কিভাবে এদের পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করা যায়, দিনরাত তার মনের ভিতরে শুধু এ চিন্তা বিরাজ করে।

হযরত খাদীজা (রাঃ)

অবশ্য তাঁর এ অবস্থা এবং অর্থ-সম্পদের প্রতি অনীহার ভাব লক্ষ্য করে আশ্চর্য বােধ করতেন; কিন্তু একথা সত্য যে, তিনি স্বামীর প্রতি এতটুকু বিরক্ত ছিলেন না।

হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) ধন-সম্পদের মায়ায় আকৃষ্ট না হয়ে বরং তার আকর্ষণ হতে মুক্ত হওয়ার জন্য তা দুঃখী-দরিদ্রের মধ্যে বিলাইয়া দিয়ে পূর্বের মতই আবার নিঃস্ব হলেন। তাঁর মানসিক চিন্তা ও ভাবনা এতই বৃদ্ধি পেল যে,তিনি কয়েকখানা রুটি ও কিছু খেজুর-খুরমা নিয়ে হেরা পর্বতের একটি নির্জন। গুহায় চলে যেতেন এবং একাধারে কয়েকদিন পর্যন্ত ধ্যানমগ্ন থেকে তার আহারাদি ফুরাইয়া গেলে বাড়ী আসতেন।

আবার কিছু খাবার নিয়ে গিয়ে ধ্যানে। বসিতেন। অনেক সময় স্বয়ং হযরত খাদীজা (রাঃ) নিজে গিয়ে স্বামীকে হেরা পর্বতের গুহায় খাবার দিয়ে আসতেন। তাঁর স্বামী যে এরূপ সংসারের সকল কাজ-কর্ম ও পার্থিব সকল চিন্তা-ভাবনা হতে দূরে থেকে এরূপ একান্ত উদাসীনভাবে কাল কাটিয়ে চলেছেন আর দিবা-নিশি গভীরভাবে কি চিন্তা করতেছেন, এ দেখে হযরত খাদীজা (রাঃ) কোনরূপ ধৈর্য হারা হতেন না।

যেহেতু তিনি তাঁর স্বামীর স্বভাব ও চরিত্র সম্পর্কে উত্তমরূপে ওয়াকিফহাল। ছিলেন। তাই তিনি মনে করতেন যে, তাঁর স্বামীর এপথ অবলম্বন নিশ্চয়ই অর্থহীন নয়; বরং এর একটি উত্তম পরিণতি বা ফলাফল অবশ্যই আছে। হযরত খাদীজা (রাঃ) সে পরিণতি বা ফলাফল লাভের প্রতীক্ষায়ই ছিলেন।

এ অবস্থা একাধারে দীর্ঘ পনের বছর পর্যন্ত চলিল। ফলাফল প্রাপ্তির শুভ মুহর্তটি ক্রমশই কাছেবর্তী হতেছিল। তা সমুপস্থিতির প্রায় ছয়মাস পূর্ব হতেই হুযুরে পাক (সাঃ) নানা ধরনের স্বপ্ন এবং বিভিন্ন রকম আভাস ইঙ্গিত পাইতে থাকেন। তিনি তা তাঁর প্রিয় সঙ্গিনী এবং সর্বাধিক হিতাকাক্ষিনী হযরত খাদীজা। (রাঃ)-এর কাছে ব্যক্ত করেন।

ভয়-ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি হইত

হযরত খাদীজা (রাঃ) তাঁর সেসব স্বপ্ন ও ইঙ্গিতাবলীর রহস্য উদঘাটন করতে না পারলেও এ যে তার স্বামীর নীরব ধ্যান ও কঠোর সাধনার ফলশ্রুতি, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতি ও বিচক্ষণা হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর তা অনুধাবন করতে। মােটেই বাকী থাকে না।

তাই তিনি স্বামী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মনে ঐ। সকল স্বপ্ন ও লক্ষণাদির প্রেক্ষিতে যে ভয়-ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি হইত, তিনি। নানারূপ সান্ত্বনা ও উৎসাহমূলক বাক্য দ্বারা তা দূর করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেন।

হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) নবুয়ত লাভের অত্যল্পকাল পূর্বে এমন একটি অপূর্ব ঘটনা ঘটিতে লাগল, তা তিনি ইতােপূর্বে আর কখনও ঘটিতে দেখেন। নেই। তিনি যখন একাকী হাঁটিতে থাকতেন, কে যেন ‘হে মুহাম্মদ! হে মুহাম্মদ! বলে আওয়াজ করতেন, কিন্তু তিনি চারদিকে তাকিয়ে কাকেও দেখতে পেতেন। না। এতে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ঘরে এসে হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর কাছে বলতেন।

হযরত খাদীজা (রাঃ

এভাবে প্রায়ই ঘটিতে লাগল। হুযুরে পাক (সাঃ)-ও প্রতিদিনকার ঘটনেট স্ত্রী খাদীজা (রাঃ)-এর কাছে বলতেছিলেন। অবশেষে খাদীজা (রাঃ) হযরত । মুহাম্মদ (সাঃ)-কে বললেন, আপনাকে যদি আবার কখনও ডাকা হয়, তবে আপনি ভয় পেয়ে ছুটে না এসে আপনি দাঁড়িয়ে শুনিবেন, আপনাকে কি বলে । আপনার ভয় পাইবার কোন কারণ নেই।
হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর কথায় হুযুরে পাক (সাঃ)-এর মনে অনেকটা সাহসেব সঞ্চার হল।।

পরদিন আবার যখন সে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। তিনি আজ আর দ্রুত চলে না এসে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কোথাও। কাকে দেখা যায় কি না ! কিন্তু কোনদিকে কাকেও দেখতে পেলেন না; কিন্তু। লক্ষ্য করলেন, শব্দটি আসমানের দিক হতেই আসতেছে।

 আল্লাহর মনােনীত রাসূল

বলা হল, ইয়া মুহাম্মদ! আপনার ভয়ের কারণ নেই। আপনি আল্লাহর মনােনীত রাসূল। আপনার উপরে। বিরাট দায়িত্ব অর্পিত হতেছে। অবিলম্বে আল্লাহ আপনার উপরে সে দায়িত্ব ন্যস্ত করবেন।।

এবার হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) সাহস করে উধ্বদিকে দৃষ্টিপাত করে। ফেরেশতা জিব্রাইলের বিরাট মূর্তি দেখলেন এবং থর থর করে কাঁপিতে কাঁপিতে বাড়ি ফিরিলেন। তারপর হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর কাছে এ ঘটনা বর্ণনা। করলেন।
হযরদ খাদীজা (রাঃ) চিন্তাৰিতা হওয়ার বদলে আরও খুশী হয়ে স্বামীকে অভয় প্রদান করলেন।

More Info: ঈমানের পর্যায়সমূহ


আমাদের কিছু কথা

বাংলায় লিখতে গিয়ে যদি কোনো ধরনের ভুল ত্রুটি হয়ে থাকে তাহলে আমাদেরকে ইমেইল করে জানিয়ে দিবেন এবং ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

এবং যদি আপনাদের কোন ধরনের সাজেশন থাকে তাহলে অবশ্য আমাদেরকে ইমেইল করে জানিয়ে দিবেন

আপনাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ

আমাদের এই পোস্টে ভিজিট করার জন্য

এবং যদি ভালো লাগে এই পোস্টটি তাহলে অবশ্যই শেয়ার করবেন।

Post a Comment

0 Comments